বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১০

স্মৃতির ডায়েরী থেকে মনের জানালায় দোলা দেয়া কিছু ঘটনা!!

মনের পাতায় জমে থাকা স্মৃতি কখনই ভোলা যায় না, হোক না তা যতই বেদনার। আর এস্মৃতি যদি হয় প্রিয়জনকে নিয়ে তাহলেতো কথাই নেই, কখনই জীবন থেকে সিফট্ ডিলিট করা যায় না! জীবনের যেকোন সময়ে তা হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আজকের আমার এই লেখাটি বিগত হওয়া আমার কিছু প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে, যারা এখন অতীত হলেও স্মৃতি থেকে এখনও তাদের সাথের যাপিত সময়গুলো অনুভব করি, মিস করি ঐ সোনালী সময়কে। কারন স্মৃতিকে কখনই দূরে ঠেলে রাখা যায় না! পেছন থেকে ঠিকই আছড়ে পরে.........

প্রথমেই আমার দাদা-দাদীঃ দাদাকে নিয়ে আমার কোন স্মৃতি নেই কারন দাদা মারা যান অনেক আগে, আব্বা সম্ভবত ক্লাস সেভেনের ছাত্র। দাদী খুব ভালো ছিলেন, হয়ত দাদার অভাবটা তিনি দুর করে দিতেন একাই, কিন্তু উনিও চলে গেছেন আমার আড়াই বছর বয়সে, কিছু ঝাপসা স্মৃতি এখনো দোলা দিয়ে যায় মনে, সেই চেহারা, বসে থাকা, দাদা ভাই বলে ডাকা, দুধের শর তুলে খাওয়ানো....।ছোটবেলায় নাকি দাদীকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতিই বলতাম, কিন্তু বড় হয়ে অনেক কিছুই ভুলে গেছি, কিন্তু যেটুকু মনের গহীনে ছড়িয়ে আছে সেটুকুই মাঝে মাঝে জলমল করে দেই ঐ সামান্য সময়টুকু! আমি জন্মের সময় থেকেই দাদী ছিলেন অসুস্থ, তাই আমাকে কোলে নিতে পারেন নি, এজন্য তার আফসোসের সীমা ছিল না। মরার আগে তাই আফসোস করে গেছেন, বংশের কনিষ্ঠ নাতিকে নিয়ে। এজন্যই কোলে নিতে না পারলেও আকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করতেন, কিন্তু আমিতো আর ওসব বুঝতাম না, থাকতে চাইতাম না, মা তখন পাশে নিয়ে শুয়ে থাকতেন.....দাদীর সাথে রাখার জন্য। মরণের আগে কনিষ্ঠ নাতির জন্য একটু বেশিই নিজের সোনার জিনিসপাতি দিয়ে গেছেন সবাইকে বলে, যে অন্যান্য নাতি-নাতনিকে কোলে পিঠে নিতে পারলেও আমাকে নিতে পারেন নি.....তাই রেখে যাওয়া সেই জিনিস আজো আছে, বহন করছে তার সময়কে, কিন্তু শুধু তিনি নেই!


নানাবাড়ি খুব কাছে হওয়ায় নানার সাথে সখ্যতা ভালো ছিল। পিচ্চি বেলায় খুব বেশি দুরন্ত না হলেও কম ছিলাম না একেবারে। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল ঘুড়ি উড়াবার। নানা আবার ভালো ঘুড়ি বানাতে পারতেন। যতই ব্যস্ততা থাকুন না কেন, নাতির আবদার কখনও ফেলতেন না, ঘুড়ি বানিয়েই ক্ষান্ত দিতেন না, আকাশে উড়িয়ে এরপর হাতে দিতেন, দেখা যেত অনেক সময় ঘুড়ির রঙ পছন্দ হয় নাই, আবার বদলিয়ে দিয়েছেন......সেই নানাও শেষ বয়সে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ধরে ধরে চলাফেরা করাতে হত। আমাদের বাড়িতে আসলে যাবার সময় হাত ধরে নানাবাড়ি পৌছে দিয়ে আসতাম, এখনও মনে হয় তার হাত ধরে বাসায় পৌছে দিচ্ছি অথবা বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠে আমাকে নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছেন। চলে গেছেন অজানাতে যখন আমি সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি। সবই আজ অতীত, না ফেরার দেশ থেকে আর কখনও ফিরবেন না, আসবেন না নাতিকে ঘুড়ি বানিয়ে দিতে। কিন্তু স্মৃতির পাতায় সবই জ্বলজ্বল করছে, সেই অনুভুতি সেই সময়, সেই নানা-নাতির চঞ্চলময় সম্পর্কগুলো। মাঝে মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিজের অজান্তে, ফিরে যাই সেই সোনালী সময়ে, আবার সচেতন হয় বাস্তবতার শব্দে.........

নানী আজ থেকেও নাই, কারন উনিও নিজে চলতে পারেন না! বাহিরে আসার সময় খুব কাঁছিলেন, জানিনা ফিরে গিয়ে দেখতে পারব কিনা! কত সামান্য আমাদের এই জীবন, অথচ আমরা এমন আচরণ করি যেন আমরা চিরদিনের জন্য আবাস গেড়েছি এই নশ্বর পৃথিবীতে।


আরও একজন দাদা ছিলেন, আমার আব্বার খালু, আমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন দাদার অভাব। উনাদের বাড়িতে আমাদের বাড়ির উপড় দিয়ে যেতে হত! আমরা অনেক কুড়ানো নাতি-নাতনিরা (আমরা সব কাজিনরা উনার মহা ভক্ত ছিলাম) ছিলাম ওনার সাথে বাঁদরামী আর ঘাড়ে চড়ার নিয়মিত সদস্য-সদস্যা। ওনার নিজের নাতি-নাতনিরা অনেক বড় ছিলেন, ফলে আমরা একচেঠিয়া ভোগ দখল করতাম দাদাকে। হাট থেকে ফেরার সময় আমরা ওৎ পেতে থাকতাম দাদার জন্য! উনিও আনতেন নাতিদের জন্য প্যাকেট ভর্তি কিছু, না হলে ওনারও নিস্তার নেই। কোন রাগ-বিরক্ত ভাব ছিল না কখনও, হাসিমুখে আমাদের সাথে মজা করতেন, কিন্তু চলে গেলেন পরপারে। যেন একটা করে ডালে আশ্রয় নেয়া আর সেটা চলে যাওয়া।তারপরও স্মৃতি হঠাৎ করেই উদগীরন করে সেই সুসময়গুলো, মনকে খারাপও যেমন করে দেয়, তেমনি ভালো লাগার একটা পরশ দিয়ে যায়.................

তারা লোকও ছিলেন পুরাতন, স্বভাবও ছিল মাটির মত নিঃস্বার্থ, সবাইকে আপন করে টেনে নিতেন, এখন আমরা আধুনিক হচ্ছি আর আবেগহীন হয়ে যাচ্ছে, পিষ্ট হচ্ছি স্বার্থের বেড়া জালে।

(৮ই অক্টোবর, ২০০৯, জাপান)
Share/Bookmark

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

^ Back to Top